মার্কিন ব্যাংকধসের ঘটনা থেকে যেসব শিক্ষা নিতে পারে বাংলাদেশ

তিন দিনের ব্যবধানে বন্ধ হয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্রের দুটি ব্যাংক—সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাংক। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর এই প্রথম সে দেশে এমন ঘটনা দেখা গেল। যদিও ওই সংকটের পর আর্থিক খাত সুরক্ষিত রাখতে অনেক ব্যবস্থাই তারা নিয়েছিল।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত কী শিক্ষা নিতে পারে, সে বিষয়ে ব্যাংকার ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেছেন, দুটি ব্যাংক বন্ধের ঘোষণার পর গ্রাহকের আমানত তারা যেভাবে সুরক্ষিত রাখল, সেটাই বাংলাদেশের জন্য বড় শিক্ষা হতে পারে। তাঁদের অভিযোগ, দেশে আমানতকারীদের চেয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও চেম্বারের স্বার্থ বেশি দেখা হয়।

২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাত শক্তিশালী করতে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। গ্রাহকদের আমানত সুরক্ষায় আড়াই লাখ ডলার পর্যন্ত আমানতের বিমা দেওয়া তার অন্যতম। ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন বা এফডিআইসি গঠন করা হয়েছে ঠিক এ লক্ষ্যেই। এর বিপরীতে বাংলাদেশে মাত্র দুই লাখ টাকা পর্যন্ত বিমা দেওয়া আছে।

এবারের সংকটে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, সংকটগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে বেলআউট করা বা নানাভাবে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়নি (২০০৮ সালে যা করা হয়েছিল), বরং সংকট গুরুতর হওয়ার আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থা তার নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়েছে। সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক ও সিগনেচার ব্যাংক—উভয় ক্ষেত্রেই এ ঘটনা দেখা গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকের পরিচালনা কর্তৃপক্ষকে সরিয়ে দেওয়া হলো। সরকার তাদের রক্ষা করার চেষ্টা করেনি।

দেখা গেল, মালিকপক্ষকে বাঁচানোর চেয়ে গ্রাহকদের কীভাবে সুবিধা হবে, তা নিশ্চিত করতেই মার্কিন সরকার ব্যস্ত। সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগ ও ফেডারেল রিজার্ভের যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, মার্কিন অর্থনীতি সুরক্ষিত ও মানুষের আস্থা ধরে রাখতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষায় এই এফডিআইসি সিগনেচার ব্যাংকের সব হিসাব আরেকটি ব্যাংক ‘ফিফথ থার্ড ব্যাংক’ করপোরেশনে স্থানান্তর করেছে। গ্রাহকদেরও সমস্যা নেই। সোমবার থেকেই গ্রাহকেরা হিসাব ব্যবহার করে স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারছেন।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, শিক্ষা এটাই, সে দেশের সরকার আমানতকারীদের সুরক্ষা দিতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। এমনকি বিমার বাইরেও আমানতের সুরক্ষা তারা দিচ্ছে। কিন্তু শেয়ারহোল্ডার ও বন্ড হোল্ডারদের সুরক্ষা দেয়নি। এটা বেলআউট নয়। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে ছাঁটাই করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।

এ ছাড়া বিমার বাইরে যে আমানত আছে, তা ফেরত দিতে ব্যাংকের সম্পদ বিক্রি করার পাশাপাশি ব্যাংক খাতের ওপর লেভি আরোপ করে আমানত ফেরত দেওয়া হবে। আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এই শিক্ষা নিতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদও মনে করেন, আমানতকারীদের সুরক্ষা দেওয়া বা তাঁদের আস্থায় আনা সবচেয়ে জরুরি বিষয়। দেশের অনেক আমানতকারী অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না, ব্যাংক সম্পর্কে মানুষের ধারণা খারাপ হচ্ছে, এটা শেষ বিচারে ব্যাংক খাতের জন্য ভালো হচ্ছে না। কারণ, এক ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হলে আরেক ব্যাংকেও তার প্রভাব পড়ছে।

সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এ ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে। সেই সঙ্গে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কথাও মাথায় রাখতে হবে। তবে তিনি পৃষ্ঠপোষক পরিচালকদের নিয়ে অতটা চিন্তিত নন, কারণ তাঁরা সুবিধাভোগী।

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন বা এফডিআইসি আড়াই লাখ ডলার পর্যন্ত আমানতের সুরক্ষা দেয়, তার বেশি নয়। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো গ্রাহকদের আশ্বস্ত করেছে, আমানতের পরিমাণ যা-ই হোক না কেন, তাঁদের ক্ষতি হবে না। যাঁদের আমানতের বিমা নেই, ব্যাংকের সম্পদ মূল্যায়ন করে তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।

বাংলাদেশে আমানতের বিমার পরিমাণ বৃদ্ধি করা উচিত বলে মত দেন সালেহউদ্দিন আহমেদ। বলেন, বিমা কোম্পানির সঙ্গে এ ধরনের ব্যবস্থায় যাওয়া যেতে পারে, মানুষও তাতে রাজি হবে। ১০ লাখ টাকা আমানতের সুরক্ষায় ৫০০ টাকা প্রিমিয়াম দিতে হলে অনেকেই দিতে রাজি হবেন বলে তিনি মনে করেন। এ নিয়ে এখন চিন্তাভাবনা করা উচিত।

সাবেক এই গভর্নর আরও বলেন, বিশেষ সময়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তেমন সময় গতানুগতিক ব্যবস্থা নিলে চলবে না।

দেশের বাস্তবতায় অনেক কিছুই করার আছে, কিন্তু কিছুই হচ্ছে না বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের সংখ্যা চার ভাগের এক ভাগে নামিয়ে আনার পাশাপাশি বাকি ব্যাংকগুলোকে একীভূত করা উচিত। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে তদারকি করাও সুবিধাজনক হবে। কিন্তু এসব না করে আমরা নিজেকে অরক্ষিত করে ফেলছি। বিশ্ববাজারে দেশের ব্যাংকগুলোর মর্যাদা নেই বললেই চলে।’

উল্লেখ্য, এসভিবি যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম বৃহৎ ব্যাংক হলেও তাদের সম্পদের পরিমাণ বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের মোট সম্পদের চেয়ে বেশি।

বড় ব্যাংকের পক্ষে ধাক্কা সামাল দেওয়া সহজ হয় বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, দেশের ব্যাংকগুলোর যা পুঁজি আছে, তা দিয়ে নতুন কোনো ধাক্কা সামাল দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সে জন্য চার-পাঁচটি ব্যাংক মিলে একটি ব্যাংক করা উচিত। এতে তাদের সক্ষমতা বাড়বে।

এ ছাড়া ব্যাংকের মালিকদের আলাদা পর্ষদে রেখে পরিচালনার দায়ভার পুরোপুরি প্রধান নির্বাহীর হাতে তুলে দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। সিইওর পর্ষদে স্বাধীন পরিচালক থাকবেন, তবে তাঁরা কারও মামাতো, খালাতো ভাই হবেন না। যোগ্য মানুষদের স্বাধীন পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। তাঁদের যথাযথ হারে সম্মানী দিতে হবে, যাতে তাঁরা দায়সারাভাবে কাজ না করেন। ভালো মানুষদের এই খাতে নিয়ে আসতে হলে এর বিকল্প নেই।

বিশ্লেষকেরা বলেন, ব্যাংকে আমানত রাখার তেমন কোনো বিকল্প নেই বলে ব্যাংক খাতের সমস্যা সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না। কিন্তু কোনো ব্যাংক বিপর্যয়ের মুখে পড়লে তার জন্য পুরো অর্থনীতিকে অনেক মূল্য চোকাতে হয়। সে জন্য ব্যাংক শক্তিশালী করার বিকল্প নেই বলেই তাঁরা মনে করেন।